স্বামী বিবেকানন্দ জন্মগ্রহণ করেন ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩। জন্মনাম নরেন্দ্রনাথ দত্ত , স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন হিন্দু সন্ন্যাসী, দার্শনিক, লেখক, সংগীতজ্ঞ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতীয় অতীন্দ্রিয়বাদী রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য। তার পূর্বাশ্রমের নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে হিন্দুধর্ম তথা ভারতীয় বেদান্ত ও যোগ দর্শনের প্রচারে প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। অনেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে বিভিন্ন ধর্মমতের মধ্যে পারস্পরিক সুসম্পর্ক স্থাপন এবং হিন্দুধর্মকে বিশ্বের অন্যতম প্রধান ধর্ম হিসেবে প্রচার করার কৃতিত্ব বিবেকানন্দকে দিয়ে থাকেন। ভারতে হিন্দু পুনর্জাগরণের তিনি ছিলেন অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। সেই সঙ্গে ব্রিটিশ ভারতে তিনি ভারতীয় জাতীয়তাবাদের ধারণাটি প্রবর্তন করেন। বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। তার সবচেয়ে বিখ্যাত বক্তৃতাটি হল, “আমেরিকার ভাই ও বোনেরা …,” ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোয় বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় প্রদত্ত চিকাগো বক্তৃতা, যার মাধ্যমেই তিনি পাশ্চাত্য সমাজে প্রথম হিন্দুধর্ম প্রচার করেন।
স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতার এক উচ্চবিত্ত হিন্দু বাঙালি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ছোটোবেলা থেকেই আধ্যাত্মিকতার প্রতি তিনি আকর্ষিত হতেন। তার গুরু রামকৃষ্ণ দেবের কাছ থেকে তিনি শেখেন, সকল জীবই ঈশ্বরের প্রতিভূ; তাই মানুষের সেবা করলেই ঈশ্বরের সেবা করা হয়। রামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর বিবেকানন্দ ভারতীয় উপমহাদেশ ভালোভাবে ঘুরে দেখেন এবং ব্রিটিশ ভারতের আর্থ-সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান অর্জন করেন। পরে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় ভারত ও হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংল্যান্ড ও ইউরোপে তিনি হিন্দু দর্শনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে অসংখ্য সাধারণ ও ঘরোয়া বক্তৃতা দিয়েছিলেন এবং ক্লাস নিয়েছিলেন। তার রচিত গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য চিকাগো বক্তৃতা, কর্মযোগ, রাজযোগ, জ্ঞানযোগ, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বেদান্ত, ভারতে বিবেকানন্দ, ভাববার কথা, পরিব্রাজক, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য, বর্তমান ভারত, বীরবাণী (কবিতা-সংকলন), মদীয় আচার্যদেব ইত্যাদি। বিবেকানন্দ ছিলেন সংগীতজ্ঞ ও গায়ক। তার রচিত দুটি বিখ্যাত গান হল “খণ্ডন-ভব-বন্ধন” (শ্রীরামকৃষ্ণ আরাত্রিক ভজন) ও “নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি”। এছাড়া “নাচুক তাহাতে শ্যামা”, “৪ জুলাইয়ের প্রতি”, “সন্ন্যাসীর গীতি” ও “সখার প্রতি” তার রচিত কয়েকটি বিখ্যাত কবিতা। “সখার প্রতি” কবিতার অন্তিম দুইটি চরণ– “বহুরূপে সম্মুখে তোমার ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর? / জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।” – বিবেকানন্দের সর্বাধিক উদ্ধৃত একটি উক্তি।
ভারতে বিবেকানন্দকে ‘বীর সন্ন্যাসী’ নামে অভিহিত করা হয় এবং তার জন্মদিনটি ভারতে জাতীয় যুব দিবস হিসেবে পালিত হয়।
জন্ম | ১২ জানুয়ারি ১৮৬৩ | মৃত্যু | ৪ জুলাই ১৯০২ |
জাতীয়তা | ভারতীয় | প্রতিষ্ঠাতা | রামকৃষ্ণ মিশন, রামকৃষ্ণ মঠ |
গুরু | রামকৃষ্ণ | কর্ম | জ্ঞানযোগ, মদীয় আচার্যদেব, ভারতে বিবেকানন্দ |
জীবনী
বিবেকানন্দের পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল নরেন্দ্রনাথ দত্ত (ডাকনাম ছিল বীরেশ্বর বা বিলে এবং নরেন্দ্র বা নরেন)। ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে ১২ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উৎসবের দিন উত্তর কলকাতার সিমলা অঞ্চলে ৩ নম্বর গৌরমোহন মুখোপাধ্যায় স্ট্রিটে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা বিশ্বনাথ দত্ত কলকাতা উচ্চ আদালতের একজন আইনজীবী ছিলেন। বিবেকানন্দ একটি প্রথাগত বাঙালি কায়স্থ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যেখানে তার নয় জন ভাই-বোন ছিল। তার মধ্যম ভাই মহেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট লেখক ও বিদেশ ভ্রমণে বিবেকানন্দের সঙ্গী। কনিষ্ঠ ভাই ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন বিশিষ্ট সাম্যবাদী নেতা ও গ্রন্থকার।
১৮৭১ খ্রিষ্টাব্দে, নরেন্দ্রনাথ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে তার পরিবার সাময়িকভাবে রায়পুরে (অধুনা ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ছত্তিসগড় রাজ্যে) স্থানান্তরিত হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি এই বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে দত্ত পরিবার আবার কলকাতায় ফিরে আসেন। নরেন্দ্রনাথ প্রেসিডেন্সি কলেজের (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা) প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। তিনিই ছিলেন সেইবছর উক্ত পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ একমাত্র ছাত্র। তিনি প্রচুর বই পড়তেন। দর্শন, ধর্ম, ইতিহাস, সমাজবিজ্ঞান, শিল্পকলা ও সাহিত্য বিষয়ে বই পড়ায় তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। বেদ, উপনিষদ্, ভাগবদগীতা, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ প্রভৃতি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ পাঠেও তার আগ্রহ ছিল। এছাড়া তিনি হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তালিম নিতেন এবং নিয়মিত অনুশীলন, খেলাধুলো ও সমাজসেবামূলক কাজকর্মে অংশ নিতেন।
জেনেরাল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনে (অধুনা স্কটিশ চার্চ কলেজ, কলকাতা) পড়ার সময় নরেন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য যুক্তিবিদ্যা, পাশ্চাত্য দর্শন ও ইউরোপীয় ইতিহাস অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চারুকলা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। নরেন্দ্রনাথ ডেভিড হিউম, জর্জ ডব্লিউ. এফ. হেগেল, আর্থার সোফেনহায়ার, ওগুস্ত কোঁত, জন স্টুয়ার্ট মিল ও চার্লস ডারউইনের রচনাবলি পাঠ করেছিলেন। হারবার্ট স্পেনসারের বিবর্তনবাদের প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন। সে সময়ে স্পেনসারের সঙ্গে তার চিঠিপত্র বিনিময়ও চলত। স্পেনসারের এডুকেশন (১৮৬১) বইটি তিনি বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন। পাশ্চাত্য দার্শনিকদের রচনাবলি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংস্কৃত ধর্মগ্রন্থ ও বাংলা সাহিত্য নিয়েও চর্চা করেন। জেনেরাল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনের প্রিন্সিপাল উইলিয়াম হেস্টি লিখেছেন, “নরেন্দ্র সত্যিকারের মেধাবী। আমি বহু দেশ দেখেছি, কিন্তু তার মতো প্রতিভা ও সম্ভাবনাময় ছাত্র দেখিনি; এমনকি জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দর্শন ছাত্রদের মধ্যেও না।” কয়েকটি স্মৃতিকথায় নরেন্দ্রনাথকে ‘শ্রুতিধর’ (অদ্ভুত স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন ব্যক্তি) হিসেবে উল্লেখ করতেও দেখা যায়।
১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে, তিনি কেশবচন্দ্র সেনের নব বিধানের সদস্য হয়েছিলেন, যা রামকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎের পর এবং খ্রিস্টান ধর্ম থেকে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সেন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ নরেন্দ্রনাথ ফ্রিম্যাসনারি লজের সদস্য হয়েছিলেন এবং তার কুড়ি বছর বয়সে কেশবচন্দ্র সেন ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্রাহ্মসমাজেরও সদস্য হন। ১৮৮১ থেকে ১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেনের ব্যান্ড অব হোপ-এ সক্রিয় ছিলেন, যা যুবসমাজকে ধূমপান এবং মদ্যপানে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করেছিল।
নরেন্দ্র প্রাশ্চাত্য ধর্মবিশ্বাস এসোটিরিসিজমের সঙ্গে পরিচিত হয়ে ওঠেছিলেন। তার প্রারম্ভিক ধর্মবিশ্বাস ব্রাহ্ম ধারণার আদলে গড়ে উঠেছিল। এই সময় তিনি নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাসী হন এবং পৌত্তলিকতার সমালোচকে পরিণত হন। এবং দৃঢ়ভাবে উপনিষদ ও বেদান্তের যৌক্তিকীকরণ, মসৃণ, একেশ্বরবাদী ধর্মতত্ত্ব নির্বাচনী ও আধুনিক পঠন নির্ধারণ করেছিলেন।
এই সময় নরেন্দ্রনাথ ব্রাহ্মনেতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে দেখা করে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, “আপনি ঈশ্বরকে দেখেছেন?” এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে দেবেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তোমার চোখদুটি যোগীর ন্যায়।” দর্শন সম্পর্কে তার জ্ঞানে সন্তুষ্ট না হয়ে নরেন্দ্রনাথ ভাবতে থাকেন, ঈশ্বর ও ধর্ম সত্যিই কি মানুষের ক্রমবর্ধমান অভিজ্ঞতার অংশ। তিনি এই নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করেন। কলকাতার অনেক বিশিষ্ট অধিবাসীকে তিনি জিজ্ঞাসা করেন, তারা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন কিনা। কিন্তু কারোর উত্তরই তাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি।
১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দে নরেন্দ্রনাথ প্রথম রামকৃষ্ণ দেবের সাক্ষাৎ পান।
নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কথা প্রথম শোনেন জেনারেল অ্যাসেম্বলি’জ ইনস্টিটিউশনে পড়ার সময়। অধ্যাপক উইলিয়াম হেস্টি একটি সাহিত্যের ক্লাসে উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থের দ্য এক্সকারশন কবিতাটি পড়ানোর সময় রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কথা বলেছিলেন। উক্ত কবিতায় ব্যবহৃত ‘trance’ কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি ছাত্রদের বলেন, ‘trance’ বিষয়টির সত্যিকারের অর্থ বুঝতে হলে ছাত্রদের দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে দেখতে হবে। এই কথা শুনে নরেন্দ্রনাথসহ কয়েকজন ছাত্র রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে দেখতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে এফএ পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়ার সময় রামচন্দ্র দত্ত একবার নরেন্দ্রনাথকে সুরেন্দ্রনাথ মিত্রের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে ধর্মোপদেশ দানের জন্য নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এই সাক্ষাৎকারে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব তরুণ নরেন্দ্রনাথকে একটি গান গাইতে বলেন। পরে নরেন্দ্রনাথের সঙ্গীতপ্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব তাকে দক্ষিণেশ্বরে নিমন্ত্রণ করেন। যদিও রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব বা নরেন্দ্রনাথ কেউই এই সাক্ষাৎকে পরবর্তীকালে তাদের প্রথম সাক্ষাৎ হিসেবে গুরুত্ব দেননি। এমনকি তারা এই সাক্ষাৎের কথা উল্লেখও করতেন না।
১৮৮১ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে অথবা ১৮৮২ খ্রিষ্টাব্দের প্রথম দিকে দুজন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে নরেন্দ্রনাথ দক্ষিণেশ্বরে আসেন রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এই সাক্ষাৎ নরেন্দ্রনাথের জীবনে একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গে নরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “তাহাকে [রামকৃষ্ণ দেব] একজন সাধারণ লোকের মতো বোধ হইল, কিছু অসাধারণত্ব দেখিলাম না। অতি সরল ভাষায় তিনি কথা কহিতেছিলেন, আমি ভাবিলাম, এ ব্যক্তি কি একজন বড় ধর্মাচার্য হইতে পারেন? আমি সারা জীবন অপরকে যাহা জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাহার নিকটে গিয়া তাহাকেও সেই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘মহাশয়, আপনি কি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন?’ তিনি উত্তর দিলেন- ‘হাঁ।’ ‘মহাশয়, আপনি কি তাহার অস্তিত্বের প্রমাণ দিতে পারেন?’ ‘হাঁ’। ‘কি প্রমাণ? ‘ ‘আমি তোমাকে যেমন আমার সম্মুখে দেখিতেছি, তাহাকেও ঠিক সেইরূপ দেখি, বরং আরো স্পষ্টতর, আরো উজ্জ্বলতররূপে দেখি।’ আমি একেবারে মুগ্ধ হইলাম। আমি দিনের পর দিন এই ব্যক্তির নিকট যাইতে লাগিলাম। ধর্ম যে দেওয়া যাইতে পারে, তাহা আমি বাস্তবিক প্রত্যক্ষ করিলাম। একবার স্পর্শে, একবার দৃষ্টিতে একটা সমগ্র জীবন পরিবর্তিত হইতে পারে। আমি এইরূপ ব্যাপার বারবার হইতে দেখিয়াছি।” প্রথমদিকে অবশ্য নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে গুরু বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেছিলেন। এমনকি তার চিন্তাভাবনার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ প্রকাশও করেছিলেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ব্যক্তিত্বের প্রতি তিনি বিশেষভাবে আকৃষ্টও হয়েছিলেন। এর ফলে ঘন ঘন তিনি দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত শুরু করেন।প্রথমদিকে তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের ভাবাবস্থা ও দেবদেবীর সাক্ষাৎ দর্শনকে ‘কাল্পনিক সৃষ্টি’ ও ‘অলীক বস্তুর অস্তিত্বে বিশ্বাস’ মনে করতেন। ব্রাহ্মসমাজের সদস্য নরেন্দ্রনাথ সেই সময় মূর্তিপুজো, বহুদেববাদ ও রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কালীপুজো সমর্থন করতেন না। এমনকি অদ্বৈত বেদান্ত মতবাদকেও তিনি ঈশ্বরদ্রোহিতা ও পাগলামি বলে উড়িয়ে দিয়ে সেই মতবাদকে উপহাস করতেন। নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে পরীক্ষা করতেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবও শান্তভাবে তার যুক্তি শুনে বলতেন, “সত্যকে সকল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার চেষ্টা করবি।
১৮৮৪ খ্রিষ্টাব্দে নরেন্দ্রনাথের পিতা হঠাৎ মারা যান। এরপর তার পরিবার তীব্র অর্থকষ্টের মধ্যে পড়ে। ঋণদাতারা ঋণশোধের জন্য তাদের তাগাদা দিতে শুরু করে এবং আত্মীয়স্বজনরা তাদের পৈতৃক বাসস্থান থেকে উৎখাত করার চেষ্টা শুরু করে। একদা সচ্ছল পরিবারের সন্তান নরেন্দ্রনাথ কলেজের দরিদ্রতম ছাত্রদের অন্যতম ছাত্রে পরিণত হন। তিনি চাকরির অনুসন্ধান শুরু করেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে ওঠেন। কিন্তু একই সময়ে দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের সান্নিধ্যে তিনি শান্তি পেতে থাকেন।
একদিন নরেন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কাছে অনুরোধ করেন, তিনি যেন কালীর কাছে তার পরিবারের আর্থিক উন্নতির জন্য প্রার্থনা জানান। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব তাকে বলেন, তিনি যেন নিজে মন্দিরে গিয়ে প্রার্থনা করেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের পরামর্শ অনুসারে, নরেন্দ্রনাথ তিনবার মন্দিরে যান। কিন্তু জাগতিক প্রয়োজনের জন্য প্রার্থনার পরিবর্তে তিনি জ্ঞান ও বিবেক-বৈরাগ্য প্রার্থনা করেন। এরপর নরেন্দ্রনাথ ঈশ্বর-উপলব্ধির জন্য সংসার ত্যাগ করতে মনস্থ করেন এবং রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবকে গুরু বলে মেনে নেন।
১৮৮৫ খ্রিষ্টাব্দে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের গলার ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসার প্রয়োজনে তাকে প্রথমে উত্তর কলকাতায় শ্যামপুকুর ও পরে কাশীপুরের একটি বাগানবাড়িতে স্থানান্তরিত করা হয়। এই সময় নরেন্দ্রনাথসহ রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের অন্যান্য শিষ্যগণ তার সেবা-যত্ন করেন। এই সময়ও নরেন্দ্রনাথের ধর্মশিক্ষা চলতে থাকে। কাশীপুরে নরেন্দ্রনাথ নির্বিকল্প সমাধি লাভ করেন। নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য কয়েকজন শিষ্য এই সময় রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের কাছ থেকে সন্ন্যাস ও গৈরিক বস্ত্র লাভ করেন। এভাবে রামকৃষ্ণ শিষ্যমণ্ডলীতে প্রথম সন্ন্যাসী সংঘ স্থাপিত হয়। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব নরেন্দ্রনাথকে শিক্ষা দেন মানব সেবাই ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সাধনা। তিনি নরেন্দ্রনাথকে তার অন্যান্য সন্ন্যাসী শিষ্যদের দেখভাল করতেও বলেন এবং তাকেই সন্ন্যাসী সংঘের নেতা নির্বাচিত করেন। কথিত আছে, শ্রীরামকৃষ্ণের অবতারত্ব নিয়ে বিবেকানন্দের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলে শ্রীরামকৃষ্ণ দেব ঘোষণা করেছিলেন, “যে রাম, যে কৃষ্ণ, সে-ই ইদানীং এ শরীরে রামকৃষ্ণ… ” ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অগাস্ট শেষরাত্রে কাশীপুরেই রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব প্রয়াত হন।
বরাহনগরে রামকৃষ্ণ মঠ প্রতিষ্ঠা
রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মৃত্যুর পর তার ভক্ত ও অনুরাগীরা তার শিষ্যদের সাহায্য করা বন্ধ করে দেন। বাড়িভাড়ার টাকা জোগাড় করতে না পারায়, নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য শিষ্যেরা বসবাসের জন্য নতুন বাসস্থানের খোঁজ শুরু করেন। অনেকে বাড়ি ফিরে গিয়ে গৃহস্থ জীবন যাপন করতে থাকেন। অবশিষ্ট শিষ্যদের নিয়ে নরেন্দ্রনাথ উত্তর কলকাতার বরাহনগর অঞ্চলে একটি ভাঙা বাড়িতে নতুন মঠ প্রতিষ্ঠা করার কথা চিন্তা করেন। বরাহনগর মঠের এই বাড়িটির ভাড়া কম ছিল। “মাধুকরী” অর্থাৎ সন্ন্যাসীদের ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে এই বাড়িভাড়ার টাকা জোগাড় করা হত। বরাহনগর মঠ হল রামকৃষ্ণ মঠের প্রথম ভবন। এই মঠে নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য শিষ্যেরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করতেন এবং কঠোর ধর্মানুশীলন অভ্যাস করতেন। পরবর্তীকালে নরেন্দ্রনাথ বরাহনগর মঠের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন:
বরাহনগর মঠে আমরা অনেক তপস্যা করতাম। ভোর তিনটের সময় ঘুম থেকে উঠে আমরা জপ ও ধ্যানে মগ্ন হয়ে যেতাম। সেই সময় কী তীব্র বৈরাগ্য জন্মেছিল আমাদের মনে! জগৎ আছে কি নেই সে কথা আমরা ভাবতামও না।
১৮৮৭ খ্রিষ্টাব্দে, নরেন্দ্রনাথ বৈষ্ণব চরণ বসাকের সঙ্গে সঙ্গীতকল্পতরু নামে একটি সঙ্গীত-সংকলন সম্পাদনা করেন। নরেন্দ্রনাথ-ই এই বইটির অধিকাংশ গান সংকলন ও সম্পাদনা করেছিলেন। কিন্তু প্রতিকূল পরিস্থিতির জন্য তিনি বইটির কাজ শেষ করে যেতে পারেননি।
সন্ন্যাস গ্রহণ
১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে, নরেন্দ্রনাথের গুরুভ্রাতা বাবুরামের মা নরেন্দ্রনাথ ও অন্যান্য সন্ন্যাসীদের আঁটপুর গ্রামে আমন্ত্রণ জানান। তারা সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করে হুগলি জেলার আঁটপুরে যান এবং কিছুদিন সেখানে থাকেন। আঁটপুরেই বড়দিনের পূর্বসন্ধ্যায় নরেন্দ্রনাথ ও আটজন শিষ্য আনুষ্ঠানিকভাবে সন্ন্যাস গ্রহণ করেন। তারা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবের মতো করে জীবনযাপনের সিদ্ধান্ত নেন। নরেন্দ্রনাথ “স্বামী বিবিদিষানন্দ” নাম গ্রহণ করেন। শিকাগো যাওয়ার পথে তিনি ” বিবেকানন্দ ” ছদ্মনাম টি গ্রহণ করেন । পরবর্তী কালে ঐ নামটি সর্বাধিক প্রচারিত হয়।
বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন
প্রথম বিশ্বধর্ম মহাসম্মেলন ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউটে উদ্বোধন হয়। এদিন বিবেকানন্দ তার প্রথম সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। তিনি ভারত এবং হিন্দু ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন। প্রথমদিকে বিচলিত থাকলেও তিনি বিদ্যার দেবী সরস্বতীর নিকট মাথা নোয়ালেন এবং তার বক্তৃতা শুরু করলেন এভাবে, “আমেরিকার সমবেত ভগিনী ও ভ্রাতাগণ!” তার এ সম্ভাষণে প্রায় সাত হাজারের মত দর্শক-শ্রোতা দুই মিনিট দাঁড়িয়ে তাকে সংবর্ধনা জানান। নীরবতা ফিরে আসার পর তিনি তার বক্তৃতা শুরু করলেন: “আমার পূর্ববর্তি বক্তারা যে সহিষ্ণুতা ও মহাজাগতিক গ্রহনযোগ্যতার দাবি করেছেন, সেই সহিষ্ণুতা ও মহাজাগতিক গ্রহণযোগ্যতা বিশ্ব শিখেছে সেই ধর্মের সর্বাধিক প্রাচীন সন্ন্যাসীদের বৈদিক ক্রমানুসারে” তিনি জাতিসমূহের কনিষ্ঠতমকে অভিবাদন জানালেন। তিনি ইহুদীদের ওপর রোমান আক্রমণ এবং ইহুদী মন্দির ধ্বংস হয়ে যাবার পর ভারতে আশ্রয় এবং পারসিক জাতির ভারতে আশ্রয় নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে বিশ্বে দরবারে ভারতের অবদান ও ভারতের মাহাত্ম্য তুলে ধরলেন।গীতা থেকে এ সম্পর্কে দুটি উদাহরণমূলক পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করেন-“যেহেতু বিভিন্ন স্রোতধারার উৎসসমূহ বিভিন্ন জায়গায় থাকে, সেগুলির সবই সমুদ্রের জলে গিয়ে মিশে যায়, সুতরাং, হে প্রভু, বিভিন্ন প্রবণতার মধ্য দিয়ে মানুষ বিভিন্ন যে সকল পথে চলে, সেগুলো বিভিন্ন রকম বাঁকা বা সোজা মনে হলেও, সেগুলি প্রভুর দিকে ধাবিত হয়!” এবং “যে আকারের মধ্য দিয়েই হোক না কেন, যে-ই আমার নিকট আসে, আমি তাঁর নিকট পৌঁছাই; সকল মানুষই বিভিন্ন পথে চেষ্টা করছে যা অবশেষে আমার নিকট পৌঁছায়।” সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা হওয়া সত্ত্বেও এটি সভার আত্মা এবং এর বিশ্বজনীন চেতনা ধ্বনিত করে।
আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে বক্তৃতাদান
ধর্মসভা শেষ হওয়ার পর বিবেকানন্দ যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন স্থানে অতিথি হিসেবে ভ্রমণ করেন। তার জনপ্রিয়তা “সহস্র জীবন ও ধর্মের” উপর নতুন অভিমতের দ্বার উন্মোচন করে। ব্রুকলিন এথিক্যাল সোসাইটির একটি প্রশ্ন-উত্তর পর্বের সময়, তিনি মন্তব্য করেছিলেন, “প্রাশ্চাত্যের প্রতি আমার একটি বার্তা রয়েছে, যেমনটা বুদ্ধের ছিল প্রাচ্যের প্রতি।”
শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউটে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের সেপ্টেম্বরে ধর্মসভা শেষ হওয়ার পর বিবেকানন্দ পুরো দু-বছর পূর্ব ও কেন্দ্রীয় যুক্তরাষ্ট্রে বিশেষ করে শিকাগো, ডেট্রয়েট, বোস্টন এবং নিউইয়র্কে অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। ১৮৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নিউইয়র্কে বেদান্ত সোসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের বসন্তকালের মধ্যে তার অব্যাহত প্রচেষ্টার কারণে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন এবং তার স্বাস্থ্য হয়ে পড়ে দুর্বল। তার বক্তৃতাদান সফর স্থগিত করার পর স্বামীজি বেদান্ত ও যোগের উপর বিনামূল্যে ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দের জুন থেকে দুই মাসব্যাপী তিনি থাউজ্যান্ড আইল্যান্ড পার্কে তার এক ডজন শিষ্যকে ব্যক্তি পর্যায়ে শিক্ষা দেয়ার জন্য ভাষণ দেন। বিবেকানন্দ এটিকে আমেরিকায় তার প্রথম ভ্রমণের সবচেয়ে সুখী অংশ বলে বিবেচনা করতেন।
আমেরিকায় তার প্রথম পরিদর্শনের সময় ১৮৯৫ ও ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি দু-বার ইংল্যান্ড ভ্রমণ করেন এবং সেখানে তার বক্তৃতাসমূহ সফল ছিল। এখানে তিনি সাক্ষাৎ পান এক আইরিশ মহিলা মিস মার্গারেট নোবলের; যিনি পরে ভগিনী নিবেদিতা নামে পরিচিত হন। ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে তার দ্বিতীয় ইংল্যান্ড ভ্রমণের সময় পিমলিকোতে এক গৃহে অবস্থানকালে বিবেকানন্দ দেখা পান অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বিখ্যাত ভারততত্ত্ববিদ ম্যাক্স মুলারের, যিনি পাশ্চাত্যে রামকৃষ্ণের প্রথম আত্মজীবনী লেখেন। ইংল্যান্ড থেকে তিনি অন্যান্য ইউরোপীয় দেশেও ভ্রমণ করেছেন। জার্মানিতে তিনি আরেক ভারততত্ত্ববিদ পল ডিউসেনের সঙ্গ সাক্ষাৎ করেন। তিনি দুটি শিক্ষায়তনিক প্রস্তাবও পান, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচ্য দর্শনের চেয়ার এবং কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধরনের প্রস্তাব। তিনি উভয় প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, পরিভ্রমণকারী সন্ন্যাসী হিসেবে তিনি এই ধরনের কাজে স্থিত হতে পারবেন না।
কলম্বো থেকে আলমোড়া
বিবেকানন্দ ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ জানুয়ারি কলম্বো পৌঁছান এবং এক পরমানন্দদায়ক অভ্যর্থনা গ্রহণ করেন। এখানে তিনি প্রাচ্যে তার প্রথম প্রকাশ্য বক্তৃতা (ভারত, পবিত্র ভূমি) করেন। সেখান থেকে কলকাতায় তার পৌঁছানো ছিল এক বিজয়ঘটিত প্রত্যাবর্তন। তিনি ভ্রমণ করেন কলম্বো থেকে পাম্বান, রামেস্বরম, রামনাদ, মাদুরাই, কুম্বাকোনাম এবং মাদ্রাজ। এই জায়গাগুলোতে তিনি বক্তৃতা দেন। জনগণ এবং রাজারা তাকে অত্যুৎসাহী অভ্যর্থনা জানান। পাম্বানে মিছিলে রামনাদের রাজা নিজে স্বামীজির ঘোড়ার গাড়ি টানেন। মাদ্রাজে যাওয়ার পথে কতিপয় জাগয়ায় যেখানে ট্রেন থামত না সেখানে জনগণ রেললাইনে বসে ট্রেন থামাত এবং স্বামীজির বক্তৃতা শোনার পরই ট্রেনকে যেতে দিত। মাদ্রাজ থেকে তিনি কলকাতায় তার ভ্রমণ অব্যাহত রাখেন এবং আলমোড়া পর্যন্ত তার বক্তৃতা দেওয়া চালিয়ে যান। যেখানে পাশ্চাত্যে তিনি ভারতের মহান আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যের কথা বলেছিলেন, সেখানে ভারতে ফিরে তার ‘কলম্বো থেকে আলমোড়া’ বক্তৃতা ছিল জনগণের জন্য নৈতিক অনুপ্রেরণা, বর্ণাশ্রম ভাইরাস দূরীকরণ, বিজ্ঞান শিক্ষায় উৎসাহদান, দেশের শিল্পায়ন, দারিদ্র্য দূরীকরণ, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান। এ সমস্ত বক্তৃতা কলম্বো থেকে আলমোড়া বক্তৃতা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। এই বক্তৃতাসমূহকে জাতীয়তাবাদী ঐকান্তিকতা ও আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শের প্রকাশ বলে বিবেচনা করা হয়। তার বক্তৃতাসমূহ মহাত্মা গান্ধি, বিপিন চন্দ্র পাল এবং বালগঙ্গাধর তিলকসহ আরো অনেক ভারতীয় নেতার উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিল।
রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা
অদ্বৈত আশ্রম, মায়াবতী, রামকৃষ্ণ মঠের একটি শাখা, প্রতিষ্ঠাকাল মার্চ ১৯, ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ, পরবর্তীতে স্বামী বিবেকানন্দের অনেক লেখা প্রকাশ করে, বর্তমানে “প্রবুদ্ধ ভারত” সাময়িকী প্রকাশ করে
১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের ১ মে কলকাতায় বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন ধর্ম প্রচারের জন্য সংগঠন “রামকৃষ্ণ মঠ” এবং সামাজিক কাজের জন্য সংগঠন “রামকৃষ্ণ মিশন”। এটি ছিল শিক্ষামূলক, সাংস্কৃতিক, চিকিৎসা-সংক্রান্ত এবং দাতব্য কাজের মধ্য দিয়ে জনগণকে সাহায্য করার এক সামাজিক-ধর্মীয় আন্দোলনের প্রারম্ভ। রামকৃষ্ণ মিশনের আদর্শের ভিত্তি হচ্ছে কর্ম যোগ। স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা দুটি মঠ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল যার মধ্যে কলকাতার কাছে বেলুড়ের মঠটি রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় করা হয়েছিল এবং অন্যটি হিমালয়ের মায়াবতীতে আলমোড়ার নিকটে অদ্বৈত আশ্রম নামে পরিচিত এবং পরে তৃতীয় মঠটি মাদ্রাজে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। ইংরেজিতে প্রবুদ্ধ ভারত ও বাংলায় উদ্বোধন নামে দুটি সাময়িকী চালু করা হয়েছিল। একই বছর মুর্শিদাবাদ জেলায় স্বামী দুর্ভিক্ষের জন্য অখণ্ডানন্দ কর্তৃক ত্রাণ কাজ চালু করা হয়েছিল।
১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দে পাশ্চাত্যে স্বামীজির প্রথম ভ্রমণের সময় যখন তারা একত্রে ইয়োকাহামা থেকে শিকাগো যাত্রা করেছিলেন তখন বিবেকানন্দ স্যার জামশেদজি টাটাকে একটি গবেষণা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছিলেন। আনুমানিক এই সময়ে স্বামীজি টাটার প্রতিষ্ঠিত “বিজ্ঞান গবেষণা প্রতিষ্ঠান”-এর প্রধান হওয়ার অনুরোধ সংবলিত একটি চিঠি পান। কিন্তু বিবেকানন্দ প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন এই বলে যে, সেটি তার আধ্যাত্মিক আগ্রহের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ।
বিবেকানন্দ পরে পুনঃসংস্কারকৃত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পক্ষের আর্য সমাজ ও গোঁড়া হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পক্ষের সনাতনপন্থীদের মধ্যে ঐকতান প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাঞ্জাব ভ্রমণ করেন। রাওয়ালপিণ্ডিতে তিনি আর্য সমাজবাদী ও মুসলিমদের মধ্যেকার সক্রিয় বিরোধ নির্মূল করার পদ্ধতি সম্পর্কে পরামর্শ দেন। তার লাহোর ভ্রমণ স্মরণীয় তার বিখ্যাত বক্তৃতার জন্য এবং একজন গণিতের অধ্যাপক তীর্থ রাম গোস্বামীর সঙ্গ তার সম্পৃক্ততার জন্য। যে অধ্যাপক পরে স্বামী রাম তীর্থ নামে সন্ন্যাসজীবন গ্রহণ করেন এবং ভারতে ও আমেরিকায় বেদান্ত প্রচার করেন। তিনি দিল্লি এবং খেতরিসহ অন্যান্য জায়গায়ও ভ্রমণ করেন এবং ১৮৯৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারিতে কলকাতায় ফিরে আসেন। পরবর্তী কয়েক মাস তিনি মঠের কাজ সংহত করতে এবং শিষ্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অতিবাহিত করেন।
শেষ জীবন
বেলুড় মঠে স্বামী বিবেকানন্দ মন্দির, বিবেকানন্দের পার্থিব শরীরের অন্তিম সংস্কার করার স্থানে
৪ জুলাই ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দ, (তার মৃত্যুর দিন) বিবেকানন্দ ভোরে ঘুম থেকে ওঠেন, বেলুড় মঠের চ্যাপেলে তিন ঘণ্টা ধরে ধ্যান করেন। এরপর তিনি ছাত্রদের শুক্লা-যজুর্বেদ শেখান, যা একটি সংস্কৃত ব্যাকরণ এবং যোগ দর্শন। পরে সহকর্মীদের সঙ্গে রামকৃষ্ণ মঠের বৈদিক কলেজে একটি পরিকল্পনার আলোচনা করেন। তিনি ভ্রাতা-শিষ্য স্বামী প্রেমানন্দের সঙ্গে হাঁটেন এবং তাকে রামকৃষ্ণ মঠের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও নির্দেশনা দেন। সন্ধ্যা ৭:০০ টায় বিবেকানন্দ তার ঘরে ফেরেন এবং তাকে বিরক্ত করতে নিষেধ করেন; এর প্রায় দুই ঘণ্টা পর রাত ৯:১০ মিনিটে ধ্যানরত অবস্থায় তিনি মৃত্যু বরণ করেন। তার শিষ্যদের মতে, বিবেকানন্দের মহাসমাধি ঘটেছিল; আর চিকিৎসকের প্রতিবেদনে বলা হয় এটি হয়েছে তার মস্তিষ্কে একটি রক্তনালী ফেটে যাবার কারণে, কিন্তু তারা মৃত্যুর প্রকৃত কারণ উদ্ধার করতে পারেননি। তার শিষ্যদের মতানুসারে ব্রহ্মরন্ধ্র-মস্তিষ্কের চূড়ার রন্ধ্র-অবশ্যই ফেটে থাকবে যখন তিনি মহাসমাধি অর্জন করেছিলেন। বিবেকানন্দ চল্লিশ বছর জীবৎকাল পূর্ণ করার আগেই তার ভাববাণী সম্পূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাকে বেলুড়ে গঙ্গা নদীর তীরে একটি চন্দন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া চিতার উপর দাহ করা হয়, যার বিপরীত পাশে ষোল বছর আগে রামকৃষ্ণ দেবের মরদেহ দাহ করা হয়েছিল।
স্বামী বিবেকানন্দের ভ্রমণসমূহ, উত্তেজনাপূর্ণ বক্তৃতাদান, ব্যক্তিগত আলোচনা এবং চিঠিপত্রের আদান-প্রদান তার স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছিল। তিনি হাঁপানি, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য শারীরিক অসুখে ভুগছিলেন। তার দেহত্যাগের কিছুদিন পূর্বে তাকে ইচ্ছাকৃতভাবে বর্ষপঞ্জি/পঞ্জিকা পড়তে দেখা যেত। তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার তিন দিন পূর্বে তাকে দাহ করার স্থান দেখিয়ে দেন – যে স্থানে বর্তমানে তার স্মৃতিতে একটি মন্দির দাঁড়িয়ে আছে। তিনি কতিপয় লোকের কাছে মন্তব্য করেছিলেন যে তিনি চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচবেন না।
0 Comments