রবীন্দ্র সেতু (পূর্বনাম হাওড়া ব্রিজ) হুগলি নদীর উপর অবস্থিত কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগরক্ষাকারী সেতুগুলির মধ্যে অন্যতম। ১৮৭৪ সালে প্রথম হাওড়া সেতু নির্মিত হয়। পরে ১৯৪৫ সালে পুরনো সেতুটির বদলে বর্তমান বহির্বাহু সেতুটির উদ্বোধন হয়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন সেতুটির নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র সেতু রাখা হয়। রবীন্দ্র সেতু বঙ্গোপসাগরীয় প্রবল ঝড়ঝঞ্জাগুলি সহ্য করতে সক্ষম। এই সেতু দিয়ে দৈনিক ৮০,০০০ যানবাহনও প্রায় ১০ লক্ষ পথচারী চলাচল করে। এই জাতীয় সেতুগুলির মধ্যে রবীন্দ্র সেতু বিশ্বে ষষ্ঠ বৃহত্তম।

হাওড়া ব্রিজ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হুগলি নদীর উপর অবস্থিত বড় খিলানযুক্ত একটি ঝুলন্ত সেতু৷ সেতুটি ১৯৪৩ সালে অনুমোদিত হয়৷ প্রকৃতপক্ষে সেতুটির নামকরণ করা হয় নিউ হাওড়া ব্রিজ হিসাবে, কেননা একইস্থানে অবস্থিত কলকাতা এবং হাওড়া জেলার মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী একটি ভাসমান সেতুর পরিবর্তে এই সেতুটি নির্মাণ করা হয়৷ ১৯৬৫ সালে সেতুটির নাম ভারত এবং এশিয়ার প্রথম নোবেল বিজয়ী বিখ্যাত বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে পুনঃ নামকরণ করা হয়৷

স্থানাঙ্ক২২°৩৫′০৭″ উত্তর ৮৮°২০′৪৯″ পূর্বঅতিক্রম করেহুগলি নদী,(গঙ্গা)
বহন করেবাস, ট্যাক্সি, মোটরবাইক, ছোট গাড়ি,পদচারীস্থানকলকাতা,পশ্চিমবঙ্গ,ভারত
নকশাক্যন্টিলিভার সেতুমোট দৈর্ঘ্য৭৫০ মিটার
দীর্ঘতম স্প্যান৪৪৭ মিটারচালু১৯৪৫ সালে

ইতিহাস

ব্রিটিশ প্রশাসন ১৮৫৫-৫৬ সালে প্রথম একটা সেতুর কথা ভেবেছিল। তৈরি হয়েছিল কমিটিও। কারণ, তত দিনে নদীর দু’পাড়েই জাঁকিয়ে বসেছে ইংরেজদের কারবার। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কারখানা। তাই হাওড়া-কলকাতার জন্য একটি সেতু এ বার দরকার। ’৫৫-এর সেতু কমিটি চর্চা শুরু করলেও কোনও এক অজ্ঞাত কারণে বছর চারেক পর ১৮৫৯-৬০ সালে সেতু নির্মাণের প্রস্তাব ঠান্ডা ঘরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

১৮৬২ সালে বাংলার সরকার ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ে কোম্পানির চীফ ইঞ্জিনিয়ার জর্জ টার্নবুলকে হুগলি নদীর উপর একটি ব্রিজ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য বলেন৷ ২৯ এ মার্চ তিনি প্রয়োজনীয় নকশা এবং উপাত্তসমূহ উপস্থাপন করেন৷ কিন্তু সে সময়ে ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়নি৷

আট বছর পর ঠিক হয়, এ বার সেতু একটা বানাতেই হবে। ত়ৎকালীন বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর সিদ্ধান্ত নেন, সেতু নির্মাণের যাবতীয় দায়িত্ব সরাসরি সরকারের হাতে থাকবে না। ১৮৭১ সালে তৈরি হয় একটি ট্রাস্ট। সেই ট্রাস্টের অধীনেই হাওড়ার প্রথম ভাসমান সেতু নির্মাণের ভার দেওয়া হয়।

নদীর ওপর ছিল পন্টুন ব্রিজ বা ভাসমান সেতু। নিচে নৌকা, উপরে পাটাতন। মাঝ বরাবর খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা। লম্বায় ১৫২৮ ফুট, ৪৮ ফুট চওড়া। দু’পাশে সাত ফুটের ফুটপাত। জাহাজ-স্টিমার চলাচলের জন্য সেতুর মাঝখানে ২০০ ফুট খুলে দেওয়া যেত। স্টিমার এলেই সেতু বন্ধ। ভোঁ ভোঁ শব্দ করে স্টিমার পেরিয়ে যাবে, তার পর আবার খুলবে সেতু। পুরনো হাওড়া ব্রিজের নকশা বানিয়েছিলেন স্যর ব্র্যাডফোর্ড লেসলি । ব্রিটিশ শাসনে রেল কোম্পানির খ্যাতনামা ইঞ্জিনিয়ার। এ দেশের বড় বড় রেলসেতুর নকশা তিনিই বানিয়েছিলেন। যেমন, নৈহাটির জুবিলি ব্রিজ। লেসলি সাহেব বিলেত থেকে এসে সেতু নির্মাণের এলাকা ঘুরে দেখে গিয়েছিলেন। ফিরে গিয়ে তৈরি করেন নকশা।

১৮৭১ সালে বাংলার ছোট লাট যখন ‘হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’ তৈরি করেছিলেন, তখনই সেতু পেরোতে টোল বসানো হয়েছিল। টোলের টাকাতেই চলত সেতুর রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। ’৭১-এ আইন হওয়ার পর স্যর লেসলিকেই সেতু নির্মাণের ভার দেওয়া হয়। তিনি বিলেতে ফিরে গিয়ে সেতুর ডেক এবং ভাসমান সমতল ‘নৌকা’ বানানোর কাজ শুরু করালেন। জাহাজে সেই মাল পৌঁছল কলকাতা বন্দরে। তার পরে একে একে সমতল নৌকার উপর পর পর ডেকগুলি জুড়ে তৈরি হল প্রথম হাওড়া ব্রিজ। ১৮৭৪ সালে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় সেই সেতু। অর্থাৎ ১৮৫৫ সালে ব্রিটিশ প্রশাসন যা পরিকল্পনা করেছিল, তা রূপায়িত হল ১৯ বছর পর।

সে সময় পন্টুন ব্রিজ তৈরি করতে লেসলি সাহেবের সংস্থাকে দিতে হয়েছিল ২২ লক্ষ টাকা। সেতু থেকে সর্বমোট টোল আদায় হয়েছিল ৩৪ লক্ষ ১১ হাজার টাকা। বছরে কমপক্ষে দেড় লক্ষ টাকা টোল আদায় হয়েছে সে সময়। তবে ভাসমান সেতুর সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাহাজ-স্টিমার যাতায়াতের ব্যবস্থা করা। জাহাজ গেলেই গাড়ি চলাচলের জন্য সেতু বন্ধ হয়ে যেত। যানজটের বহরও বাড়ত দিনের বেশির ভাগ সময়। কারণ, দিনের বেলাতেই কেবলমাত্র সেতু খোলা যেত। এই ব্যবস্থা চলে ১৯০৬ সাল পর্যন্ত। তার পর রাতেও জাহাজের জন্য সেতু খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়। তাতে আগে যেখানে দিনে ২৪ বার সেতু খুলতে হত, তা কমে যায়। দিনে মাত্র চার বার সেতু খুললেই কাজ মিটে যেত। বন্দরের নথি বলছে, ১৯০৭-০৮ সালে হাওড়া ব্রিজের মাঝখান দিয়ে ৩০২০টি জাহাজ-স্টিমার-লঞ্চ গিয়েছিল। তবে রাতে জাহাজ চলাচলের ব্যবস্থা হলেও যানজটের সমাধান হচ্ছিল না। ফলে সে সময় থেকেই হাওড়াতে একটি নতুন সেতু নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে থাকে ব্রিটিশ প্রশাসন।

সেতুর পরিকল্পনা

১৯০৬ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের চিফ ইঞ্জিনিয়ার জন স্কট, ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ের চীফ ইঞ্জিনিয়ার আর এস হায়েট এবং কলকাতা কর্পোরেশন এর চীফ ইঞ্জিনিয়ার ডাব্লিউ বি ম্যাকাবে এর নেতৃত্বে একটি কমিটি নিয়োগ করে৷ চীফ ইঞ্জিনিয়ারদের নেতৃত্বাধীন কমিটি প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করে৷ সকল তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নদীটির উপর একটি ভাসমান সেতুর বদলে একটি বহির্বাহু সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়৷ এই পরিকল্পনা মোটেই পছন্দ হয়নি স্যর লেসলির। কারণ, তখনও পর্যন্ত পৃথিবীতে তিনটি মাত্র বহির্বাহু সেতু বানানো হয়েছে। নতুন প্রযুক্তি নিয়ে ভারতে পরীক্ষানিরীক্ষা করতে চাননি তিনি। এর মধ্যেই ১৯১৭ সালে বহির্বাহু সেতু প্রযুক্তিতে তৈরি কানাডার পোঁ দ্য কেবেক সেতু (Pont de Quebec) ভেঙে পড়েছিল। লেসলি সাহেব নতুন একটি ভাসমান সেতুর পক্ষেই মত দিয়েছিলেন। একই মতামত ছিল পোর্ট কমিশনারেরও। কারণ, বন্দরের কাছে সেতুতে গরুর গাড়ি চলাচলের চেয়ে বিলেত থেকে আসা জাহাজ চলাচল আরও বেশি জরুরি ছিল।

প্রাথমিক কমিটি গঠনের পর ১৯১১ সালে নতুন হাওড়া সেতু নির্মাণের নকশা চাওয়া হয়। পরের বছর সারা বিশ্ব থেকে ৯টি সংস্থা ১৮টি নকশা জমা দেয়। কিন্তু সব ক’টি নকশাই ছিল বাসকুল মডেলে। অর্থাৎ সেতুর মাঝ বরাবর খোলা রাখার ব্যবস্থা রেখেছিল সব সংস্থাই। এর মধ্যে এসে পড়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ব্রিটিশরা নতুন কোনও পরিকাঠামো প্রকল্প থেকে সরে আসে। ১৯১৭ থেকে ১৯২৭ পর্যন্ত যুদ্ধের কবলে পড়ে অর্থনীতিও ধাক্কা খায়। এ দেশে আমদানি কমতে থাকে। ফলে নতুন করে কোনও প্রকল্প হাতে নেওয়ার ক্ষেত্রে রক্ষণাত্মক হয়ে পড়ে ব্রিটিশ প্রশাসন। ১৯২১ সালে ফাইল ঝেড়ে ফের চর্চা শুরু হয়।

আর তা শুরু হতেই সামনে এসে পড়ে পোর্ট কমিশনার আর রেলওয়ে চিফ ইঞ্জিনিয়ারের ভিন্ন মতের কথা। এক জন পন্টুন ব্রিজ চান তো অন্য জন বহির্বাহু সেতু। ব্রিটিশ প্রশাসন একটি মধ্যপন্থা বার করেন। ১৯২১ সালে স্যর রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়কে (আর এন মুখার্জি) মাথায় রেখে একটি কমিটি গড়ে দেন। তিনি তখন মার্টিন অ্যান্ড কোম্পানির অন্যতম মালিক। কমিটির সদস্য তৎকালীন কলকাতা বন্দরের চেয়ারম্যান ক্লিমেন্ট হিন্ডলে, চিফ ইঞ্জিনিয়ার জে ম্যাগ্লাসান। কমিটি তৎকালীন বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়ার বেসিল মট-এর পরামর্শ গ্রহণ করেন। স্যর বেসিলই প্রথম ‘সিঙ্গল স্প্যান আর্চড ব্রিজ’-এর প্রস্তাব করেন। ১৯২২ সালে আর এন মুখার্জি কমিটি চূড়ান্ত রিপোর্ট পেশ করে। তাতে যাবতীয় বিতর্ক সরিয়ে বহির্বাহু সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়। ঠিক হয়, এমন প্রযুক্তি হবে যাতে সেতুর নীচ দিয়ে অনায়াসে জাহাজ-স্টিমার যাতায়াত করতে পারবে।

১৯২৬-এ পাস হয় ‘দ্য নিউ হাওড়া ব্রিজ অ্যাক্ট’। সম্ভবত দেশের প্রথম সেতু হাওড়া ব্রিজ, যার নির্মাণ, রক্ষণাবেক্ষণ ইত্যাদি আইনসিদ্ধ। আইন পাস তো হলই, এর পর ১৯৩০ সালে ১৫ মার্চ বাংলার গভর্নর বৈঠক ডেকে সেতু নির্মাণের জন্য এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন।

১৯৩৫ সালে নতুন হাওড়া ব্রিজের আইন সংশোধিত হয় এবং পরের বছর ব্রিজটি নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়৷

নির্মাণ

সেতু নির্মাণে সাড়ে ২৩ হাজার টন ইস্পাত দিয়েছিল টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি। এই সেতুই সম্ভবত ভারতের প্রথম মেক ইন ইন্ডিয়া প্রকল্প।

সেতুর ফ্যাব্রিকেটর কোম্পানি ছিল ব্রেথওয়েট, বার্ন অ্যান্ড জেসপ (বিবিজে) । ১৯৩৭-এ ব্রিজ তৈরি শুরু হয়, কাজ শেষ হয় ১৯৪২-এর অগস্টে। ১৯৪৩-এর তেসরা ফ্রেব্রুয়ারিতে তা জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

কলকাতা ও হাওড়া জেলার মধ্যে চলাচলের ক্ষেত্রে হাওড়া ব্রিজ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে৷ প্রতিদিন ব্রিজটির উপর দিয়ে প্রায় ১,৫০,০০০ জন পথযাত্রী এবং ১,০০,০০০ গাড়ি চলাচল করে থাকে৷

আরো পড়ুন : স্বামী বিবেকানন্দ জীবনী – Swami Vivekananda Biography
আরো পড়ুন : Great Purba Medinipur History – পূর্ব মেদিনীপুর ইতিহাস
আরো পড়ুন : Hooghly Imambara History – হুগলি ইমামবাড়া ইতিহাস

Get Touch on Social Media

Instagram-greatwestbengal
Facebook-greatwestbengal
Youtube-greatwestbengal
Twitter-greatwestbengal
Telegram-greatwestbengal

Great Bengal

West Bengal is a state in eastern India, between the Himalayas and the Bay of Bengal. Its capital, Kolkata (formerly Calcutta), retains architectural and cultural remnants of its past as an East India Company trading post and capital of the British Raj. The city’s colonial landmarks include the government buildings around B.B.D. Bagh Square, and the iconic Victoria Memorial, dedicated to Britain’s queen.

0 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Howrah Bridge History – রবীন্দ্র সেতু ইতিহাস স্বামী বিবেকানন্দ জীবনী – Swami Vivekananda Biography Purba Medinipur History – পূর্ব মেদিনীপুর ইতিহাস